হুমায়ুন আহমেদ থেকে শুরু আমার বইপ্রীতির যাত্রাহুমায়ূন আহমেদের নুহাশ পল্লী
বাংলাদেশের সাহিত্য জগতে হুমায়ুন আহমেদ একটি অমলিন নাম। তাঁর সাহিত্য, নাটক, গান, সিনেমা এবং জীবনের প্রতিটি দিকেই এক ধরনের অনন্যতা ছিল। আমি সবসময় বইয়ের প্রতি নিরাসক্ত ছিলাম, বই পড়া যেন আমার কাছে ছিল কেবল পরীক্ষার খাতায় নাম লেখানোর জন্য। কিন্তু জীবনের এক পর্যায়ে একটি ভ্রমণ আমার ভেতরে বইয়ের প্রতি ভালোবাসার অদ্ভুত এক আগুন জ্বালিয়ে দিলো।
গাজীপুরের নুহাশ পল্লী – প্রকৃতির এক স্বর্গরাজ্য, যেখানে নিঃশব্দে শুয়ে আছেন বাংলার শ্রেষ্ঠ কথাশিল্পী হুমায়ুন আহমেদ। আমি আর আমার কয়েকজন বন্ধু মিলে সেখানে গিয়েছিলাম তাঁর সমাধি দর্শনের উদ্দেশ্যে। তখনো বুঝিনি, এই সফর আমার জীবনধারাকে পাল্টে দেবে।
নুহাশ পল্লীতে প্রথম অভিজ্ঞতা
নুহাশ পল্লীতে প্রবেশ করার মুহূর্তে আমার চোখে ভেসে উঠেছিল অগণিত গাছ, প্রকৃতির শান্ত সৌন্দর্য আর পাখির কিচিরমিচির। জায়গাটা যেন এক টুকরো শিল্পকর্ম। আমি ভাবছিলাম, এতো সুন্দর পরিবেশে থেকে হুমায়ুন আহমেদ কীভাবে অসংখ্য সাহিত্য সৃষ্টি করেছিলেন।
আমরা যখন তাঁর সমাধির সামনে দাঁড়ালাম, তখন এক অদ্ভুত নীরবতা নেমে এলো চারপাশে। মনে হচ্ছিল, এ জায়গাটির প্রতিটি গাছপালা তাঁর স্মৃতিকে ধারণ করে রেখেছে। তখনই আমি প্রথমবার উপলব্ধি করি—একজন লেখক শুধু বই লিখেন না, তিনি মানুষের জীবনে অমর হয়ে থাকেন তাঁর সৃষ্টির মাধ্যমে।
বইয়ের প্রতি আকর্ষণের সূচনা
নুহাশ পল্লী ভ্রমণের পর আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, হুমায়ুন আহমেদের লেখা অন্তত একটি বই পড়বো। প্রথম যেই বই হাতে পেলাম সেটি ছিল “নন্দিত নরকে”। বইটির প্রথম কয়েকটি অধ্যায় পড়ার পরই আমি বুঝতে পারলাম, আমি যেন অন্য এক জগতে ঢুকে গেছি। সহজ ভাষায় এত গভীর কথা বলার ক্ষমতা সত্যিই বিস্ময়কর।
এরপর একে একে পড়তে শুরু করলাম শঙ্খনীল কারাগার, মিসির আলি সিরিজ, হিমু সিরিজ এবং আরও অনেকগুলো উপন্যাস। প্রতিটি বই আমার কাছে হয়ে উঠল নতুন এক অভিজ্ঞতা।
হুমায়ুন আহমেদের সাহিত্য ও আমার জীবন
হুমায়ুন আহমেদ তাঁর বইয়ে এমনভাবে চরিত্রগুলোকে ফুটিয়ে তুলেছেন যে পাঠকের মনে হয়, এরা আমাদের আশেপাশের মানুষ। মিসির আলির রহস্যময়তা, হিমুর উদাসীনতা কিংবা শুভ্রর নির্লিপ্ততা—সব চরিত্রই আমাকে নিজের ভেতরে নতুন কিছু আবিষ্কার করতে শিখিয়েছে।
আমি আগে বই পড়াকে সময়ের অপচয় ভাবতাম। কিন্তু ধীরে ধীরে বুঝলাম, বই মানুষের চিন্তাভাবনাকে প্রসারিত করে, জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দেয়। একসময় টিভি বা মোবাইলের প্রতি যে আসক্তি ছিল, তা বইয়ের পৃষ্ঠায় হারিয়ে গেল।
কেন বই পড়া জরুরি
হুমায়ুন আহমেদের মাধ্যমে আমি বই পড়ার স্বাদ পেয়েছি। এরপর থেকেই বুঝতে পেরেছি—
- বই মানুষকে অন্য জগতে ভ্রমণ করায়।
- নতুন জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা দেয়।
- চিন্তাশক্তি ও সৃজনশীলতা বৃদ্ধি করে।
- একাকীত্বকে দূর করে।
- মানসিক প্রশান্তি আনে।
আমার মনে হয়, বই শুধু জ্ঞান দেয় না, বরং মানুষের ভেতরে লুকিয়ে থাকা সৌন্দর্যও জাগিয়ে তোলে।
হুমায়ুন আহমেদের উত্তরাধিকার
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে হুমায়ুন আহমেদ এক যুগান্তকারী ব্যক্তিত্ব। তিনি শুধু লেখক নন, বরং একজন কাহিনীকার, চলচ্চিত্র নির্মাতা, নাট্যকার এবং গীতিকার। তাঁর প্রতিটি কাজ সাধারণ মানুষের কাছে বোধগম্য ছিল, তাই তিনি এতটা জনপ্রিয় হয়েছিলেন।
নুহাশ পল্লীতে গিয়ে তাঁর সমাধির সামনে দাঁড়িয়ে আমি বুঝেছিলাম—তিনি শারীরিকভাবে হয়তো আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু তাঁর লেখা চিরকাল বেঁচে থাকবে।
বইয়ের প্রেমে পড়া—আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা
আজ আমি গর্ব করে বলতে পারি, আমি বইয়ের প্রেমে পড়েছি। আমার এই যাত্রা শুরু হয়েছিল নুহাশ পল্লী থেকে। যদি সেই দিন আমি বন্ধুদের সাথে সেখানে না যেতাম, হয়তো আজও বইয়ের প্রতি আমার আগ্রহ তৈরি হতো না।
এখন আমার বুকশেলফ ভর্তি বিভিন্ন বই—কখনো হুমায়ুন আহমেদ, কখনো জাফর ইকবাল, কখনো আবার বিশ্বসাহিত্যের অনন্য কিছু রচনা। প্রতিদিন কিছু না কিছু পড়ার চেষ্টা করি। বই পড়া আমার কাছে এখন শুধু অভ্যাস নয়, বরং জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
![]() |
নুহাশপল্লী দর্শনার্থী প্রবেশের নিয়মাবলী |
নুহাশপল্লী দর্শনার্থী প্রবেশের নিয়মাবলী
প্রবেশমূল্য: ২০০/- টাকা
১. যারা হুমায়ুন আহমেদের সমাধি পরিদর্শন করতে চান, তাদের জন্য প্রবেশপত্র সাথে রাখা আবশ্যক।
২. প্রবেশের সময় থেকে বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত নুহাশপল্লীর নির্ধারিত এলাকায় অবস্থান করতে হবে। বিকাল ৫টার পর দর্শনার্থী অবস্থান করা যাবে না।
৩. প্রবেশের সময় দর্শনার্থীদের প্রবেশপত্র দেখাতে হবে।
৪. একটি টিকেট একবারের জন্য প্রযোজ্য এবং একদিনের বেশি কার্যকর নয়।
৫. সকল প্রকার গান-বাজনা, মাইক ব্যবহার এবং উচ্চস্বরে শব্দ সৃষ্টিকারী কার্যক্রম সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ।
৬. হুমায়ুন আহমেদের সমাধির চারপাশে শালীনতা বজায় রাখতে হবে এবং কোনোরূপ অনভিপ্রেত আচরণ করা যাবে না।
৭. দর্শনার্থীদের জন্য নুহাশপল্লীর অভ্যন্তরে কোনরূপ দোকান, খাবার বিক্রয় বা ব্যবসায়িক কার্যক্রম সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
৮. দর্শনার্থীরা নির্দিষ্ট ডাস্টবিনে ময়লা ফেলবেন।
৯. কোনো ধরনের ক্ষতিকারক দ্রব্য বহন করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
১০. দর্শনার্থীরা ভেতরে প্রবেশ করে যে কোনো ঘটনার দায়ভার সম্পূর্ণ নিজ দায়িত্বে বহন করবেন।
বি. দ্র: নুহাশপল্লী থেকে অর্জিত আয়ের পুরোটাই এখানকার রক্ষণাবেক্ষণ এবং হুমায়ুন আহমেদ কর্তৃক নেত্রকোনার কুতুপপুরে প্রতিষ্ঠিত শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ-এর যাবতীয় খরচ মেটানোর জন্য ব্যয় করা হয়।
উপসংহার
আমার জীবনের অন্যতম বড় পরিবর্তন এসেছে হুমায়ুন আহমেদের কারণে। নুহাশ পল্লীর সেই সফর আমাকে বইয়ের প্রেমে ফেলেছে। আজ আমি বিশ্বাস করি, যে মানুষ বইয়ের প্রেমে পড়ে, সে কখনো একা হয় না। বই হলো মানুষের সেরা বন্ধু, শ্রেষ্ঠ শিক্ষক এবং অমূল্য সম্পদ।
তাই আমি সবাইকে বলব—বই পড়ুন, নিজেকে আবিষ্কার করুন। হয়তো একদিন আপনার জীবনও বদলে যাবে, যেমনটা বদলেছে আমার।